July 16, 2021
বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তি অবিশ্বাস্যগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আর ভবিষ্যতে প্রযুক্তি পৌঁছে যাবে আরও অনন্য এক উচ্চতায়, যা আমরা সাধারণ মানুষ হয়ত কল্পনাও করতে পারছি না এ সময়ে বসে। বিশ্বের উন্নত দেশের প্রযুক্তির সাথে অনুন্নত দেশসমূহের প্রযুক্তির আসমান-জমিন ফারাক এখনই খুব স্বাভাবিক বিষয়।
সুতরাং, ভবিষ্যতে এ বৈষম্য যে আরও বৃদ্ধি পাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রযুক্তির এই পরিবর্তনের সাথে বদলে যাবে আমাদের জীবনযাত্রাও।
কেমন হতে পারে ২০৩০ সালের বিশ্ব? এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ’র এক প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে পূর্বাভাস জানিয়েছেন বিশ্বের তাবৎ বাঘা বাঘা প্রযুক্তিবিদেরা। চলুন জেনে নেওয়া যাক কী ভাবছেন তারা।
এরিক ব্রাইনজল্ফসন পরিচালক, এমআইটি ইনিশিয়েটিভ অন দ্য ডিজিটাল ইকোনমি (যুক্তরাষ্ট্র)
গত কয়েক দশকে মেশিন লার্নিং দারুণভাবে অগ্রসর হলেও, ২০০৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনশীলতা প্রায় ৫০ শতাংশে নেমে গেছে। নতুন নতুন প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো আবিস্কারের পরপরই উৎপাদনশীলতা কিছুটা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু তার পরেই তা কমতে থাকে। এতে অবশ্য প্রচুর সময়ের প্রয়োজন হয়। বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের পর শিল্পায়ন ঘটে। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পর শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হয়। কম্পিউটারের কল্যাণের সমাজের অনেক পরিবর্তন স্বাধীন সাধিত হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক বৈশ্বিক ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে, ই-কমার্স কিন্তু এখনো ব্যবসায়িক দুনিয়ার খুবই ছোট একটি অংশ। একইভাবে আমাদের অর্থনীতিকে পরিবর্তন করার জন্য মেশিন লার্নিং সিস্টেমকেও অনেক সময় নিতে হবে। এ মুহূর্তে যা দরকার তা হলো বিনিয়োগ। আর এই বিনিয়োগ করতে হবে সেসব দক্ষতা, ব্যবসায় ইত্যাদিতে যেগুলো তাদের সাপ্লাই চেইন, কাস্টমারের সাথে সম্পর্ক, এবং তাদের সেবা ইত্যাদি প্রসঙ্গে নতুন করে চিন্তা করছে। আর কেবল এই পরিবর্তন সাধিত হলেই উৎপাদনশীলতা ক্রমশ অনলাইন দুনিয়ার সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জড়িয়ে যাবে।
ওয়ানুরি কাহিউ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক এবং ফিল্মমেকার (কেনিয়া)
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটের সাথে মানুষের সম্পর্ক কী রকম হতে পারে তা পরীক্ষা করার জন্য আফ্রিকাকে বেছে নেওয়া হবে বলে আমি মনে করি। আজ থেকে ১০ বছর আগে কিনশাসাতে রোবট ট্রাফিক পুলিশ ব্যবহার করা হয়েছিল এবং দেখা গেল মানুষ তাদেরকে বেশি মেনে চলছে কারণ রোবটেরা ঘুষ খায় না। আফ্রিকার অনেক সমস্যা সমাধানের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে আর এটি খুবই দরকার। কারণ .২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর চারজন মানুষের মধ্যে একজন হবেন আফ্রিকান।
হেলেনা লিউরেন্ট মহাপরিচালক, কনজিউমার্স ইন্টারন্যাশনাল (যুক্তরাজ্য)
ভোক্তার ডেটা সুরক্ষার জন্য ডেটা ট্রাস্ট গড়ে উঠবে। ডেটা ট্রাস্ট এবং ডেটা সমন্বয়ের মাধ্যমে ভোক্তারাও তাদের অধিকার নিয়ে আরও বেশি সচেতন হতে পারবেন। তারা জানতে পারবেন তাদের ডেটা কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, চাইলে নেগোশিয়েট করতে পারবেন কীভাবে তা ব্যবহার করা যাবে, এবং তাদের ওপর নজরদারির ব্যাপারেও তারা সতর্ক থাকতে পারবেন। ডেটার সহায়তায় তারা সরাসরি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে পারবেন যেমন একজন ভোক্তা চাইলেই তাদের ডেটা ট্রাস্টের মাধ্যমে সরাসরি কৃষকের সাথে যুক্ত হতে পারবেন এবং সে অনুযায়ী নিজের পছন্দমত ভোগ্যপণ্য ক্রয় করতে পারবেন।
মাইকেল কেসি চিফ কনটেন্ট অফিসার, কয়েন ডেস্ক, (যুক্তরাষ্ট্র)
ডলারকে বিশ্বের অনেক দেশ তাদের রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু ভবিষ্যতে ডলারের স্থান দখল করে নিতে পারে ডিজিটাল কারেন্সি। ডিজিটাল কারেন্সি সঞ্চয়, স্থানান্তর সবকিছু করা হবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। বিভিন্ন চুক্তির জন্য ব্যবহার করা হবে ডিজিটাল কারেন্সি। এর মানে হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানির ডলারের ক্ষমতা কমে যাবে এবং বৈশ্বিক, বিকেন্দ্রীকৃত এবং ছোট ছোট ইনোভেটিভ কোম্পানিগুলোর ক্ষমতা বাড়বে।
জিনভিভ বেল পরিচালক, থ্রিএ ইনস্টিটিউট , সিনিয়র ফেলো, ইন্টেল (অস্ট্রেলিয়া)
গত ছয় সপ্তাহ ধরে আমার দেশ দাবানলে পুড়ছে। আমার মনে হয় আমরা এখন যে পৃথিবীতে বাস করছি, ২০৩০ দেখতে এমনটাই লাগবে। প্রথমত, জলবায়ু ক্রমশ আরও দ্রুততার সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সময়মতো দাবানলের পূর্বাভাস, অপসারণের অনুরোধ বাতাসের মানের রিপোর্ট ইত্যাদি সম্পর্কে যথাসময়ে জানার জন্য অস্ট্রেলিয়ানরা তাদের ব্যক্তিগত ডেটা, ও সরকারি ডেটা কীভাবে সুলভ করা যায় সে ব্যাপারে আগের চেয়ে আরও বেশি করে ভাবতে শুরু করেছে। সুতরাং, এক সময় আমরা যারা প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করি, তারা ডেটা নিয়ে মাথা ঘামালেও, বর্তমানে এই ইস্যুটি মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তৃতীয়ত, এটা না মেনে উপায় নেই যে ২০ শতকের সার্বিক অবকাঠামো ভীষণ ভঙ্গুর, এবং তার জন্য ২১ শতককে চালিয়ে নিতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হবে।
জাখারি বোগ ব্যবস্থাপনা অংশীদার, ডেটা কালেকটিভ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (যুক্তরাষ্ট্র)
বিগত ৮০, ৯০ বছর ধরে আমাদের যাবতীয় বস্তু তৈরীর উপাদান ছিল পেট্রোলিয়াম। পেট্রোলিয়াম থেকে আমরা তৈরি করেছি জ্বালানি তেল, প্লাস্টিক, ঔষধ ইত্যাদি। আমার মনে হয় ২০২০-এর দশককে আমরা মনে রাখব জীববিজ্ঞানের আবিষ্কার দ্বারা পরিচালিত একটি দশক।
জিন প্রকৌশল-এর সাহায্য নিয়ে এমন সব যৌগিক যৌগ তৈরি করা হবে যেগুলো দিয়ে নতুন নতুন উপাদান তৈরি করা যাবে যার দ্বারা আমাদের জীবনযাত্রা এবং অর্থনীতি আরও সহজ ও অগ্রসরপূর্ণ হবে। ইতোমধ্যে তা শুরু হয়েছে। জিন প্রকৌশলের সাহায্যে আমরা এখনই প্রতিস্থাপনমূলক কিছু দ্রব্য তৈরি করেছি আর এসব কিছুর পেছনে রয়েছে কম্পিউটার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতা।
রোনাল্ডো লেমোস পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর টেকনোলজি অ্যান্ড সোসাইটি অভ রিও (ব্রাজিল)
২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনপ্রিয় মোবাইল ফোন ব্র্যান্ডগুলো হবে চীনের। এই ফোনগুলোর থাকবে নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম এবং অ্যান্ড্রয়েডের বাজারের অর্ধেক দখল করে নেবে এই নতুন অপারেটিং সিস্টেমওয়ালা চাইনিজ ফোন সমূহ।
শারান বারো মহাসচিব, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন (অস্ট্রেলিয়া)
থ্রিডি প্রিন্টিং, অটোমেশন, এবং রোবোটিক্স ইত্যাদির কল্যাণে উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড়সড় স্থানীয়করণ ঘটবে। দোকানে গিয়ে যদি আমরা এমন বলতে পারি যে আমার একটা প্যান্ট চাই, এক্ষুণি, যেটাতে জিন্সের স্ট্রাইপ ও তিনটা পকেট থাকবে তাহলে তা হবে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটা ঝুঁকি। খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনও স্থানীয় ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাবে। কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে ভোগ্যপণ্য গ্রহণের প্যাটার্ন-এও পরিবর্তন আসবে। তাই, সাপ্লাই চেন ভিত্তিক বৈশ্বিক ব্যবসায় অনেক গরীব দেশ থেকে বিলীন হয়ে যাবে। অই দেশগুলো, যেগুলো আগে থেকেই ধুঁকছে, সেগুলো আরও দারিদ্র্যতার মুখোমুখি হবে। আমাদেরকে মানব অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করতে হবে।
পিটার উঙ্গারো সিইও, ক্রে (যুক্তরাষ্ট্র)
এমন অনেক শতশত কোম্পানি আছে যেগুলো মোটর গাড়ি উৎপাদনকারীদের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরি করে। বর্তমানে তারা ছোট কম্পিউটার ব্যবহার করে তাদের যন্ত্রের মডেলগুলো তৈরি করার জন্য। কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন (CAD), সিমুলেশন ইত্যাদি ব্যবহার করে এসব কোম্পানি বর্তমানে তাদের কাজ সারায়। কিন্তু ভবিষ্যতে তাদের ডেটা সেটগুলো হাজার গুণ বৃদ্ধি পাবে যেগুলো হিসেব করার জন্য আরও শক্তিশালী কম্পিউটারের প্রয়োজন হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন হবে মিনি সুপার কম্পিউটার। যেকোনো একটি কম্পিউটার থেকেই অনেকস্থানেই সংযোগ দেওয়া যাবে। আর তখনকার সুপারকম্পিউটারগুলো আকারে হবে অনেক ক্ষুদ্র এবং এর জন্য প্রয়োজন হবে অনেক কম বিদ্যুৎ। হয়তো একটি সিঙ্গেল ক্যাবিনেটের মধ্যেই একটি মিনি সুপারকম্পিউটার স্থাপন করা সম্ভব হবে।