March 9, 2021
রেলস্টেশনে চায়ের ফ্লাস্ক হাতে নিয়ে ‘চা গরম’ বলে ছুটতে থাকা হকার অথবা মেট্রোপলিটন শহরের লাখ টাকার বিলবোর্ড; সবই কিন্তু মার্কেটিং-এর আওতায় পড়ে। মার্কেটিং হতে পারে বিভিন্ন রকমের, নিত্যদিনের হকারের আহ্বান যেমন এক প্রকার মার্কেটিং তেমনি কর্পোরেট দুনিয়ার চোখধাঁধানো বিজ্ঞাপনও মার্কেটিং। কিন্তু দুটোর মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে- অর্থনৈতিক, টার্গেট-অডিয়েন্স, মার্কেটিং চ্যানেল, উদ্দেশ্য ইত্যাদি পার্থক্য।
তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ ভার্চুয়াল বা ডিজিটাল দুনিয়ার সাথে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন তৈরি করেছে। কম্পিউটারের ক্ষমতাবলে সৃষ্ট এ ডিজিটাল দুনিয়ায় বিচরণ করা মানুষগুলোর কাছে নিজেদের পণ্যের খবর পৌঁছে দিতে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরাও একই মাধ্যমের সদ্ব্যবহার করছেন। এসব মাধ্যমে পণ্যের প্রচারই ডিজিটাল মার্কেটিং হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ডিজিটাল মার্কেটিং সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে আমাদের এ আয়োজন।
ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিন ইত্যাদি ব্যবহার করে যে মার্কেটিং করা হয় তাকে ডিজিটাল মার্কেটিং বলে। ভোক্তাদের কাছে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় পণ্যের খবর জানান দিতে ডিজিটাল মার্কেটিং ব্যবহার করা হয়।
ডিজিটাল মার্কেটিং মূলত প্রথাগত মার্কেটিং-এর একটি আধুনিক উপায় হলেও অনেকে এটাকে সম্পূর্ণ নতুন একটি মার্কেটিং প্রক্রিয়া বলে বিবেচনা করেন। কারণ ডিজিটাল মার্কেটিং-এর ক্ষেত্রে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর জন্য নতুন নতুন পথ বের করতে হয় এবং ভোক্তার আচরণ বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করতে হয় যা প্রথাগত মার্কেটিং-এর ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় না।
সচরাচর মার্কেটিং-এর ক্ষেত্রে টার্গেট অডিয়েন্স আগে থেকে জানা যায় না। কিন্তু ডিজিটাল মার্কেটিং-এর ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ভোক্তা শ্রেণিকে টার্গেট করে মার্কেটিং করা হয়। ইন্টারনেটভিত্তিক সার্চ ইঞ্জিনগুলোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন, ইমেইলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন পাঠানো, প্রমোটেড পোস্ট বা টুইট ইত্যাদি সবকিছুই ডিজিটাল মার্কেটিং-এর উদাহরণ। ডিজিটাল মার্কেটিং একধরণের দ্বিপক্ষীয় ও সক্রিয় মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি কারণ এতে ভোক্তা ও বিক্রেতা উভয়ের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
তবে ইন্টারনেট মার্কেটিং ও ডিজিটাল মার্কেটিং-এর মধ্যে খানিকটা তফাৎ রয়েছে। ইন্টারনেট মার্কেটিং বলতে কেবল ইন্টারনেটভিত্তিক মার্কেটিং-কে বোঝায়। কিন্তু ডিজিটাল মার্কেটিং ইন্টারনেট ছাড়াও হতে পারে। যেকোনো ডিজিটাল ডিভাইস-এর মাধ্যমেই মার্কেটিং করা সম্ভব। সেটি হতে পারে একটি মোবাইল ফোন, একটি ভিডিও গেম, একটি স্মার্টফোন অ্যাপ এবং এমনকি একটি সিনেমাও।
ডিজিটাল মার্কেটিং-এর দুনিয়ায় যারা বিজ্ঞাপন প্রদান করেন তাদেরকে সোর্স হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং যাদেরকে উদ্দেশ্য করে বিজ্ঞাপন প্রদান করা হয় তারা রিসিভার হিসেবে বিবেচিত হন। সাধারণত স্মার্ট, বিশেষ অভিজ্ঞতা ও বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রিসিভার টার্গেট করে বিজ্ঞাপন প্রদান করা হয়।
ডিজিটাল মার্কেটিং এর একটি অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে ওয়েবসাইটে ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ডিজিটাল মার্কেটিং করা একটি পদ্ধতি প্রচলিত পদ্ধতি যেকোনো অনলাইন ক্যাম্পেন তৈরি নির্বাহ প্রচার ইত্যাদি সফলভাবে করার জন্য ওয়েবসাইট এর প্রয়োজন হয়।
একটি ওয়েবসাইট কোন ব্র্যান্ড পণ্য-সেবা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করতে পারে ডিজিটাল মার্কেটিং এর জন্য ওয়েবসাইট নির্মাণের ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটটি এমনভাবে তৈরী করতে হবে যেন এটির উদ্দেশ্য দর্শকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে ওয়েবসাইটটি যেন মোবাইল ফ্রেন্ডলি হয় এবং এটি যেন খুব সহজে ব্যবহার করা যায় এসব দিকে খেয়াল রাখতে হবে
পেইড অ্যাড ব্যবহার করে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর উপায় হলো পিপিসি অ্যাডভারটাইজিং। গুগল, বিং, লিংকডইন, পিন্টারেস্ট, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মে পিপিসি ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা যায়। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যবহারকারী বিক্রেতার পণ্যের সাথে সম্পর্কিত কোন টার্ম সার্চ করলে তখন সার্চ রেজাল্টের পাশাপাশি ওই পণ্যটির বিজ্ঞাপন ব্যবহারকারীকে দেখানো হয়।
খেয়াল করলে দেখবেন, গুগলে কোনো ভোগ্যপণ্য নিয়ে সার্চ করার পর প্রথমদিকের রেজাল্টগুলোর পাশে ‘অ্যাড’ (Ads) কথাটি লেখা থাকে। কাকে কোন বিজ্ঞাপন দেখানো হবে তা নির্ধারণ করা হয় বিভিন্ন ডেমোগ্রাফিক বৈশিষ্ট্য যেমন বয়স, লিঙ্গ, অবস্থান ইত্যাদির উপর। সবচেয়ে জনপ্রিয় পিটিসি প্লাটফর্ম হলো গুগল অ্যাড এবং ফেইসবুক অ্যাড।
কনটেন্ট মার্কেটিং-এর লক্ষ্য হলো কনটেন্ট ব্যবহার করে সম্ভাব্য ক্রেতার নিকট পণ্য সম্পর্কে তথ্য পৌঁছানো। কনটেন্ট সাধারণত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইমেইল মার্কেটিং, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন সিস্টেম, পিপিসি মার্কেটিং ইত্যাদির মাধ্যমে প্রমোট করা হয়। ব্লগ, ই-বুক, অনলাইন কোর্স, ইনফোগ্রাফিক্স, পডকাস্ট, ওয়েবিনার্স ইত্যাদির মাধ্যমে কনটেন্ট মার্কেটিং করা হয়।
এখন পর্যন্ত অন্যতম কার্যকরী ডিজিটাল মার্কেটিং চ্যানেল হচ্ছে ইমেইল মার্কেটিং। পণ্যের বিস্তারিত জানিয়ে সম্ভাব্য ভোক্তার কাছে ইমেইল পাঠানোই ইমেইল মার্কেটিং। অনেকে কখনো কখনো ইমেইল মার্কেটিং-এর সাথে স্প্যাম ইমেইলকে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু আদতে স্প্যাম ইমেইলের সাথে প্রোমোশনাল ইমেইলের কোনো সম্পর্ক নেই।
ইমেইল মার্কেটিং-এর সাহায্যে বিক্রেতার ব্র্যান্ড-এর সম্ভাব্য ক্রেতা বা আগ্রহী মানুষের কাছে সহজে পৌঁছানো যায়। অনেক ডিজিটাল মার্কেটার বাকি সব ডিজিটাল মার্কেটিং চ্যানেল ব্যবহার করেন কেবল তাদের ইমেইল মার্কেটিংয়ের জন্য লিড (Leads) যোগাড় করার জন্য।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহে মার্কেটিং করাই হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহ এতটাই জনপ্রিয় যে এগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং-এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্র্যান্ড সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা এবং এসব মাধ্যমের ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে বিশ্বাস অর্জন। তবে আজকাল সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং-এর মাধ্যমে সরাসরি ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে।
মার্কেটিং-এর সবচেয়ে প্রাচীন একটি পদ্ধতি হচ্ছে অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং। অবাক শোনালেও এটিই সত্যি। ইন্টারনেটের কল্যাণে অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং শব্দটির সাথে আমরা পরিচিত হলেও ইন্টারনেট আসার আগে থেকেই এটি একটি সুপ্রচলিত মার্কেটিং পদ্ধতি হিসেবে কাজ করেছে। এ পদ্ধতিতে ইনফ্লুয়েন্সাররা যেকোনো পণ্যের প্রমোট করেন এবং তাদের প্রমোশনের সুবাদে কেউ পণ্যটি কিনলে তার থেকে কিছুটা কমিশন গ্রহণ করেন। আধুনিক ইকমার্স সাইটগুলো অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং-এর জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে প্রতি মাসে।
বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত সার্চ ইঞ্জিন হচ্ছে গুগোল আরেকটি পরে অবস্থান করছে ইউটিউব জনপ্রিয় ভিডিও প্ল্যাটফর্মকে অনেকেই বেছে নেন পণ্য সম্পর্কে জানার জন্য কোন কিছু কেনার আগে ক্রেতা অনেক সময় ইউটিউবে পণ্যের রিভিউ দেখে নেন পণ্যটি সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করেন ইউটিউব ভিডিও মার্কেটিং বর্তমানে জনপ্রিয় একটি ডিজিটাল মার্কেটিং স্ট্রাটেজি এর বাইরে ফেসবুক ভিডিও ইনস্টাগ্রাম টিকটক ইত্যাদি ব্যবহার করেও ভিডিও মারকেটিং ক্যাম্পেইনে পরিচালনা করা যায়
বিভিন্ন কোম্পানি, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান অনেক সময় এসএমএসের মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ড বা পণ্য, সেবা ইত্যাদি সম্পর্কে সম্ভাব্য ক্রেতাদের জানিয়ে থাকে। বাংলাদেশে ভোটের সময় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীরা তাদের ভোটারদের কাছে অনেক সময় ভোট চেয়ে এসএমএস পাঠান। এটি এসএমএস মার্কেটিং-এর একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত।
কোনো ব্লগ, ওয়েব কনটেন্ট ইত্যাদির ব্যাকলিংকের সাহায্যে কাস্টমার পাওয়ার বা লিড জেনারেট করার মাধ্যমে মার্কেটিং-এর উদ্দেশ্য পূরণ করা যায়। রেফারেল মার্কেটিং এসইও-এর ক্ষেত্রেও সহায়তা করে।
গুগল বা অন্য যেকোনো সার্চ ইঞ্জিনে আপনার ওয়েবসাইটটিকে সার্চ রেজাল্টের শীর্ষে নিয়ে আসার প্রক্রিয়াই হচ্ছে সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন বা এসইও। এসইও ব্যবহার করলে ওয়েবসাইটে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে অনেক বেশি ট্র্যাফিক পাওয়া যায়। এ পদ্ধতিতে যেহেতু ওয়েবসাইট গুগলে ওপরের দিকে র্যাঙ্ক করে, সেহেতু তা অধিক সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছায়। সুতরাং, এটি ডিজিটাল মার্কেটিং-এর মৌলিক উদ্দেশ্য পূরণ করে।
ডিজিটাল মার্কেটিং করলে অনেক দিক থেকেই কিছু উল্লেখযোগ্য সুবিধা পাওয়া যায়।
ডিজিটাল মার্কেটিং যে একটি নিষ্কণ্টক মার্কেটিং ব্যবস্থা তাও কিন্তু নয়। এর একটি অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ডিজিটাল চ্যানেলগুলো প্রতিনিয়ত খুবই দ্রুত গতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। আর এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে হচ্ছে ডিজিটাল মার্কেটারদের। তাদেরকে বুঝতে হচ্ছে চ্যানেলগুলো কীভাবে কাজ করে। নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হচ্ছে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর জন্য।
আর ডিজিটাল মার্কেটিং এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে ভোক্তার মনোযোগ আকর্ষণ করাও একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এত এত বিজ্ঞাপনের ভিড়ে কোন ব্যক্তি কেন আপনার বিজ্ঞাপনটির দিকেই তার কৃপাদৃষ্টি দেবে সেটিও ভাবতে হবে আর সেটি মাথা রেখেই আপনাকে আপনার ডিজিটাল মার্কেটিং কনটেন্ট তৈরি করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন ভোক্তার আচরণ ও তারা কীভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ইন্টারনেট ব্যবহার করে সে সম্পর্কে নিয়মিত গবেষণা।
অনেক ধন্যবাদ এত সুন্দর করে উপস্থাপনা করার জন্য। আপনার ব্লগটিতে এরম আর উৎকৃষ্ট মানের পোস্ট পাব এই আশা করলাম।