September 5, 2021
‘একের ভেতর সব’ নামের গাইড নিশ্চয়ই ছোটবেলায় পড়ে এসেছেন। যেখানে এক মলাটে সব বই-এর সমাধান দেওয়া থাকে। সুপারশপ তো আমাদের কাছে আর অপরিচিত কিছু নয়। যেখানে প্রায় সব ধরণের প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায়। সুপার শপের বিশেষ সুবিধে হলো ভিন্ন ভিন্ন পন্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দোকানে ঘুরে বেড়াতে হয় না।
আমাদের ফোনের র্যাম, রম বৃদ্ধির ফলে এখন প্রচুর পরিমাণে অ্যাপ ইনস্টল করে রাখা যায়। বিষয়টা এমন হয়ে গিয়েছে যে অ্যাপের ভিড়ে প্রয়োজনীয় অ্যাপ খুঁজে বের করতে অনেক সময় বিরক্তি লাগে।
কেমন হতো যদি প্রয়োজনীয় কাজ গুলো একটি অ্যাপ থেকেই করে ফেলা যেত বার বার ভিন্ন ভিন্ন অ্যাপ ওপেন না করে? হ্যাঁ, এমন ধারণা নিয়ে অনেক আগেই কাজ শুরু করে বেশ সফল হয়েছে বিশ্বের নানান অ্যাপ নির্মাতা কোম্পানি। এই একটি অ্যাপ থেকে যাবতীয় গুরুত্বপূর্ন কাজ করে ফেলা যায়। যার নাম দিয়েছে সুপার অ্যাপ।
আজকে আমরা কথা বলব এই সুপার অ্যাপ নিয়ে। জানাব এর বিস্তারিত।
একটি অ্যাপ-এর মাধ্যমে ইউজারের নিত্যনৈমিত্য সব ধরনের চাহিদাকে একত্র করে সমাধানের উদ্দ্যেশে যে অ্যাপভিত্তিক ইকোসিস্টেম তৈরি করা হয় তা-ই সুপার অ্যাপ নামে পরিচিত। যেরকমভাবে সুপারশপে সব ধরণের জিনিস একই যায়গা থেকে অ্যাক্সেস করা যায়।
সুপার অ্যাপ-এর আইডিয়াটা সর্বপ্রথম এসেছিল ব্ল্যাকভেরির ফাউন্ডার মাইক ল্যাজারিডিস-এর মাথায়। তাঁর মতে সুপার অ্যাপ এর সংজ্ঞা হলো:
“A closed ecosystem of many apps that people would use every day because they offer such a seamless, integrated, contextualized and efficient experience.”
সংক্ষেপে, সুপার অ্যাপ হলো এক প্রকার অ্যাপ যেখানে ইন-হাউজ টেকনলজি ব্যবহার করে থার্ডপার্টি ইন্টিগ্রেশনের মাধ্যমে সব ধরণের সুবিধা একত্র করে প্রদান করা হয়।
সুপার অ্যাপ-এর ধারণা জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো এক অ্যাপ-এ সব ধরণের কাজ করা সম্ভব। বেশিরভাগ মানুষ অতিরিক্ত ঝামেলা পোহাতে পছন্দ করেনা। যারা টিনেজার শুধু তারাই এক্সপ্লোর করতে চায় নতুন নতুন অ্যাপ। এছাড়া বাকিরা চায় শর্টকার্টে যে কোনো কাজ সমাধান করতে। এক্ষেত্রে যখন কেউ দেখে একটি অ্যাপ-এর মাধ্যমে প্রায় যাবতীয় সব সমস্যা সমাধান করা যায়, তবে সবাই ঐ অ্যাপকে সাদরে গ্রহন করবে এটি আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
ওয়ালেট যেই অ্যাপ-এ রয়েছে সেখান থেকে যদি ট্রান্সপোর্ট টিকেট, মোবাইল টপ-আপস, ব্যাংক লোন, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট, গ্রোসারি লেনদেন সহ আরও নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ করা যায়, তাহলে সবাই এই প্ল্যাটফর্মটিকে অবশ্যই পছন্দ করেবে, তা-ই না?
এছাড়াও সুপার অ্যাপগুলো জনপ্রিয় হওয়ার আরও বড় কারণ হলো ‘প্রাইভেসি’। সুপার অ্যাপ ব্যবহার করলে বার বার প্রতিটি অ্যাপ-কে তথ্য দিতে হয়না। সুপার অ্যাপসগুলোতে একবার রেজিস্ট্রেশন করলে ঐ সুপার অ্যাপ-এ সংযুক্ত সকল অ্যাপ-এর সুবিধা গ্রহন করা যায়।
সুপার অ্যাপ-এর সুবিধা নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন অ্যাপ এর উপর। তবে সবচেয়ে কমন কিছু ফিচার হলো বেশিরভাগ সুপার অ্যাপ ডিজিটাল ওয়ালেট, বিল পেমেন্ট, মোবাইল টপ-আপস, রাইডিং-হেইলিং, মেডিকেল অ্যাপয়েন্টমেন্ট, ফুড ডেলিভারি, ট্রান্সপোর্ট টিকেট, মিউজিক স্ট্রিমিং, ইনভেস্টমেন্ট, গ্রোসারি ডেলিভারি, হোটেল বুকিং, বিজনেস লোন, এবং মুভি টিকেট সহ নানান রকম সুবিধা পাওয়া যায়।
একবার ভাবুন তো এত সব সুবিধাসমৃদ্ধ অ্যাপ আপনি না ব্যবহার করে থাকতে পারবেন?
সব সুপার অ্যাপ-এর আইডল ধরা হয় চাইনিজ চ্যাট অ্যাপ ‘উইচ্যাট’কে। তারা সর্বপ্রথম সুপার অ্যাপ-এর ধারণা সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। তবে এই সুপার অ্যাপ এখনও পর্যন্ত এশিয়ান দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কয়েকটি জনপ্রিয় সুপার অ্যাপ হলো-
গ্র্যাব-এর যাত্রা শুরুতে রাইডিং সার্ভিস হলেও ধীরে ধীরে এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় সুপার অ্যাপ-এ পরিণত হয়েছে। সিঙ্গাপুর ভিত্তিক এই সুপার অ্যাপ-এর সর্বমোট ইউজার সংখ্যা ১৮৭ মিলিয়ন। যেখানে মুভি টিকেট, হোটেল বুকিং, ফুড ডেলিভারি, বিজনেস লোনের মত অসংখ্য সুবিধা পাওয়া যায়। গ্র্যাব অ্যাপটি অ্যাকটিভ রয়েছে সিঙ্গাপুরের ৩৩০টিরও অধিক শহরে
গো-জ্যাক ইন্দোনেশিয়ান ভিত্তিক একটি সুপার অ্যাপ। এদের যাত্রা মোটরসাইকেল রাইডিং সার্ভিস দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে এটি একটি জনপ্রিয় সুপার অ্যাপ ইন্দোনেশিয়ায়। এদের সার্ভিসগুলো হলো- ফুড ডেলিভারি, পার্সেল ডেলিভারি, মুভি টিকেটিং, গ্রোসারি ডেলিভারি ইত্যাদি।
কাকাও-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ম্যাসেজিং অ্যাপ হিসেবে। পরে তারা ২০১৪ সালে লঞ্চ করে কাকাও-পে। এটি শুধু সাউথ কোরিয়াতে ব্যবহার করা যায়। সবচেয়ে মজার তথ্য হলো সাউথ কোরিয়ার ৫০ মিলিয়ন লোকের মাঝে ৪১ মিলিয়ন লোকই এই অ্যাপ ব্যবহার করে। কাকাও-এর জনপ্রিয় সার্ভিস হলো- মিউজিক স্ট্রিমিং, ইনভেস্টমেন্ট, রাইড শেয়ারিং, ভিডিও গেমস, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ইত্যাদি।
উইচ্যাট হলো সুপার অ্যাপ জগতে যুগান্তকারী অ্যাপ। এরাই সফলভাবে সুপার অ্যাপ কনসেপ্টকে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। চীনের এই অ্যাপ-এর মান্থলি অ্যাকটিভ ইউজার প্রায় ১ বিলিয়ন। এছাড়াও প্রায় ২.৫ মিলিয়ন কোম্পানী ইউচ্যাট ব্যবহার করে তাদের অভ্যন্তরীন যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য। টেনসেন্টের তৈরি এই অ্যাপ-এর বর্তমান বাজার মূল্য ৬৮ বিলিয়ন ডলার। এদের রয়েছে ডেলিভারি ট্র্যাকিং, প্রাইস কম্পেয়ারিজন, এবং কুইক পে-এর মত যুগান্তকারী ফিচার।
৭৩০ মিলিয়ন ইউজার নিয়ে চায়নাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত সুপার অ্যাপ হলো এই আলি-পে। হ্যাঁ, এটি আলি গ্রুপেরই একটি অ্যাপ। জ্যাক মা ২০০৪ সালে এই অ্যাপটি প্রস্তুত করেন। এদের রয়েছে ১.৩ বিলিয়ন অ্যাক্টিভ ইউজার। বিল পেমেন্ট থেকে শুরু করে, ট্রাভেল রিলেটেড, অনলাইন ডিসকাউন্ট, মোবাইল টপ-আপস সহ অসংখ্য ফিচার নিয়ে আলি পে সুপার অ্যাপ জগতে বেশ শক্ত অবস্থান দখল করে আছে।
পেটিএম আরেকটি অসাধারণ সুপার অ্যাপ। ইন্ডিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় মোবাইল পেমেন্ট প্লাটফর্ম। রয়েছে প্রায় ৩৫০ মিলিয়নের মতো অ্যাক্টিভ ইউজার। এছাড়াও ২২০ মিলিয়নের অধিক কার্ড সেইভ করা রয়েছে ইউজারদের।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০১৪ সালে সুপার অ্যাপ-এর ধারণা নিয়ে যাত্রা শুরু করে সহজ অ্যাপ। এখনও পর্যন্ত এক প্লাটফর্ম থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা দিয়ে সহজ অ্যাপ নাম্বার ওয়ান সুপার অ্যাপ বাংলাদেশে। তাদের রয়েছে রাইডিং, ফুড, ট্রাক, লঞ্চ, ট্রেন/বাস টিকেট, এবং মুভি দেখার টিকেট সহ অসংখ্য ফিচার।
অনেকে ধারণা করেন সুপার অ্যাপ শুধু এশিয়ান দেশ গুলোতে ব্যবহার করা হয়। আসলে বাস্তবে এমন নয়, ল্যাতিন আমেরিকা, আফ্রিকায়ও এই সুপার অ্যাপ,-এর প্রচলন রয়েছে। আমাদের দেশেও বিকাশ কিংবা নগদ কোন একদিন পুরোদমে সুপার অ্যাপ হয়ে উঠবে।